তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে...

তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে...
০২ এপ্রিল

একটু ভেবে দেখুন তো, সর্বশেষ কবে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় থাকার পরেও টানা এত দিন ছুটি পেয়েছিলেন!? এবং এটাও ভেবে দেখুন এই লকডাউনটা কি আসলেই ছুটি?!

আমি বিগত ১০ বছরে কখনও টানা ১০ দিন বাসায় থাকতে পারিনি। আমার মনে হয় এই কথাটা আমাদের এখানে প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই সত্য। বাস্তব জীবনের ব্যাস্ততা আমাদের কাছ থেকে যে মূল্যবান জিনিষটি খুব সহজেই ছিনিয়ে নিয়েছে, সেটি হচ্ছে আমাদের সময় এবং এই জিনিষটি দিন কে দিন আরো মূল্যবান হয়ে উঠছে।

যাই হোক, সময় নিয়ে কথা বলা মূল উদ্দেশ্য নয়। করোনা বা কোভিড -১৯ এর প্রভাবে সারা বিশ্ব আজকে হঠাৎ করে যেমন থমকে গেছে, তেমনি আমরাও হঠাৎ করে অনেকটা সময় পেয়ে গেছি নিজেকে দেয়ার। সময়টাকে নতুন করে গুছিয়ে নেয়ার। কিন্তু আসলেই কী আবার নতুন করে গুছিয়ে নেয়ার দরকার আছে? চলুন এটা নিয়েই আজকে কথা বলি। তার আগে দেখি নিই সময়ের ব্যাপারটা কি?

আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন আমি সাধারণত সময়কে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলি

১. কাজের সময়

২. ব্যাক্তিগত সময়।

আজকে আমি শুধু এই কাজের সময়ের ব্যাপারে কথা বলব।

এখন তো আমরা সবাই বাসায়। তাই ভাববেন না, সব টুকু সময়ই আপনার ব্যাক্তিগত সময়। কোভিড-১৯ এর জন্য আপনার কাজের স্থান, পরিবেশ এবং পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু কাজের সময়ের কিন্তু কোন পরিবর্তন আসেনি। বরং আপনাকে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। কেন গুছিয়ে নিতে হবে এবং কিভাবে গুছিয়ে নিবেন তা জানার আগে আপনাকে কিছু জিনিষ মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে। জ্বি, ঠিক পড়েছেন - ভাবতে হবে।

দেখুন, আমরা সবাই অফিস ছেড়ে বাসায় চলে এসেছি। প্রথমেই আমাদের মাথায় আসবে আমি বাসায় মানে হচ্ছে আমি আমার নিজের মত করে থাকব। আসলেই কি তাই? অফিস থেকে বাসায় এসে অফিসের কাজ করেন না - এমন মানুষ যেমন আছে, আবার বাসায় এসে অফিসের চেয়ে অনেক বেশি অফিসের কাজ বাসায় বসে করেন এমন মানুষও আছে। ধরুন, এই করোনা পরিস্থিতি (আল্লাহ না করুক ) আরো দীর্ঘ সময় স্থায়ী হলো।

তখন কি করবেন?

কাজ করবেন না?

অফিস ছেড়ে দিবেন?

কাজ বন্ধ করে দিবেন?

টাকা আসবে কোথেকে?

খাবো কি?

খরচ যোগাবো কোথেকে আমরা?

তাহলে ভাবনাটা হচ্ছে, এই পরিস্থিতি যতদিনই থাকুক না কেন, আপনাকে এই ধারণাটা মাথায় নিয়ে নিতে হবে যে, যদি এই সমস্যা অনেক দিন ধরেও থাকে তাহলেও যেন আপনার কাজ কর্ম আপনি চালিয়ে যেতে পারেন। আর কাজ চালিয়ে যাবেন আপনি বাসা থেকে অর্থাৎ অফিসে না যেয়েই, তাই তো? আপনার অফিস আপনাকে বিশ্বাস করবে? যদি বিশ্বাস না করে, কাজের আউটপুট না পায়, আপনার আমার বেতন আসবে? আসবে না। তাহলে এই কাজ শুরু করার আগে গুছিয়ে নেয়ার কাজটা করতে যেয়ে আপনি নিজেকে উপরের এই প্রশ্নগুলো করবেন এবং এগুলোর ইতিবাচক উত্তর আসতে হবে। কিভাবে আসবে? আসবে যদি আপনার আপনার মাইন্ড সেট আপ হয় এমন -

১. অফিস বন্ধ মানেই খুব সাধারণ ধারনা হচ্ছে কাজ কর্ম নাই। কাজ নাই মানে আমার প্রয়োজন নাই অফিসে। আমার জব নাই বা চলে যাবে, তাই তো? জ্বি না, এই শূন্যতার মধ্যেই আমার নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে যাতে অফিস মনে করে আমাকে এখনও তাদের প্রয়োজন। আমাকে দিয়ে তাদের কাজ হবে। যদি ছাটাই শুরুও হয় আমার প্রয়োজনীয়তাই যেন আমাকে টিকিয়ে রাখে।

Make yourself important.

২. শুধু কাজ হবে মনে করলেই হবে না, আমি যে বাসা থেকে কাজ করব এবং সেটা সঠিক সময়ে সঠিকভাবে কারো সুপারভিশন ছাড়াই ফাঁকি না দিয়ে নিজ দায়িত্বে করতে পারি সেই বিশ্বাসযোগ্যতাটা আমার অর্জন করতে হবে।

Make yourself trustworthy.

৩. আমার কাজ দিয়ে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইমপ্যাক্ট তৈরী করতে হবে। শুধু কাজ করার জন্য করছি নাকি সেটা রেজাল্ট অরিয়েন্টেড হচ্ছে সেটাও আমাকে ভেবে দেখতে হচ্ছে। এই পয়েন্টটা একটু লক্ষ্য করুন। কাজ আমরা অফিসেও রেজাল্ট অরিয়েন্টেডই করতাম। অন্তত অফিস আমাদের কাছ থেকে তাই আশা করত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সব ধরনের অফিসের কাজ কিন্তু বাসা থেকে কাজ করতে পারব না আমরা। ধরেন মার্কেটিং, সেলস, ক্লায়েন্ট ভিজিট, সার্ভিসিং - এসব কাজ গুলা কিন্তু বাসায় বসে করার কাজও না। কিন্তু আমাদের এমন রাস্তা বের করতে হবে যাতে এরকম অনেক কাজও আমরা এই পরিস্থিতিতে চালিয়ে যেতে পারি। আর এই জায়গাতেই ম্যাক্সিমাম ইমপ্যাক্ট তৈরীর ব্যাপারটা চলে আসে।

Spent your time to create most impact.

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে করবেন। কীভাবে করবেন বলতে গেলে পোষ্ট অনেক বড় হয়ে যাবে, তাই খুবই সংক্ষেপে বলে শেষ করছি।

আর আমরা সবাই জানি সঠিক প্ল্যানিং যে কোন কাজকেই সহজ করে দেয়। তো এই গুছিয়ে নেয়ার কাজটা আমরা কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নিব।

১. প্ল্যানিং: আপনি যদি বাসায় থেকে কাজ করেন যেটাকে আমরা বলছি work from home, তাহলে আপনার কাজের সময়ের জন্য একটা রুটিন বানান। প্রতিদিন কতটুকু কাজ করবেন, কখন ব্রেক নিবেন, কখন খাবেন এবং প্রতিদিন ঠিক কখন কাজ শুরু এবং শেষ করবেন। যদি এভাবে একটা রুটিন বানিয়ে নিতে পারেন তাহলে দেখবেন বাসায় থেকে কাজ করা অফিসে বসে কাজ করার চেয়েও অনেক বেশি প্রডাকটিভ হবে। কাজের প্ল্যানিং এবং ইমপ্যাক্ট নিয়ে অন্য একটা পোষ্টে আবার বলব।

২. পরিবেশ ঠিক রাখুন: গবেষণায় দেখা গেছে বাইরের বাতাসের চেয়ে ঘরের বাতাস ৫ গুণ বেশি দূষিত হয়। আর আপনি শুরু করেছেন work from home. তাহলে প্রথমেই ঘরের বাতাস, আলো, তাপমাত্রা এসব ঠিক রাখার মাধ্যমে কাজের পরিবেশ নয় বরং সুস্থ থাকার পরিবেশ বজায় রাখুন।

৩. পরিমিত, নিয়মিত এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন: সঠিক খাবার খান, কম খান, পরিমিত খান। সুস্থ থাকুন।

৪. যোগাযোগের ধরণ পরিবর্তন করুন: আমরা সাধারণত অফিসিয়াল যোগাযোগ কিভাবে করি? ইমেইল, টেক্সট, মোবাইল কল- তাই তো। এগুলাও থাকবে কিন্তু এসবের চেয়ে অন্যান্য কমিউনিকেশন টুলস এবং টেকনোলজি ব্যাবহার করতে শিখুন। প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট এর জন্য অনলাইন টুলস আছে ব্যাবহার করুন। ক্লায়েন্ট এর অফিসে যেয়ে প্রেজেন্টেশন দেয়া সম্ভব না গুগল হ্যাঙ্গাউট ব্যাবহার করুন। গুগলের জিসুইটের কাজ শিখে নিন। মিটিং এর জন্য গুগলের Duo বা ইন্সট্যান্ট মেসেজিং এপস আছে সেগুলাকে কাজে লাগান। মোদ্দা কথা প্রযুক্তিকে আয়ত্ব করুন যাতে জীবন সহজ হয়।

৫. পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকুন: অফিসে যাবেন না বলে যেমন খুশি তেমন থাকবেন না। পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকুন। এটা নিয়ে আর বেশি কিছু বলব না। যা বলার করোনা বলবে।

৬. আলাদা কাজের জায়গা তৈরী করুনঃ একটা কথা আছে না - অফিসের কাজ বাসায় হয় না! কথা সত্য! তাহলে উপায়? উপায় হচ্ছে কাজের জন্য আলাদা জায়গা তৈরী করুন। আমি অনেক টাকা খরচ করে চেম্বার বানাতে বলছি না। ঘরের একটা কোনে একটা চেয়ার ও টেবিল নিয়ে বসুন। প্রতিদিন অই জায়গাতেই বসে কাজ করুন এবং কাজের যা কিছু প্রয়োজন সব অই জায়গাতেই গুছিয়ে হাতের কাছে রাখবেন। পরিবারকে বুঝতে দিন যে এটা আপনার কাজের জায়গা এবং আপনার রুটিনটা তাদের জানান - প্রথমেই যেটা বানিয়েছেন। তাহলে তারা আপনার কাজের সময় বিরক্ত করবেন না। কাজ দ্রুত হবে, কাজের আলাদা পরিবেশ পেয়ে যাবেন। দেখবেন প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে অই জায়গাটাতে বসার একটা তাগিদ অনুভব করছেন। বাসায় আছেন বলে একটু বেশি কাজ করার প্রেসার আসবে বা নিজেও দেখবেন করতে ভালো লাগছে। অল্প স্বল্প বেশি কাজ করতেই পারেন। প্রতিদিনের অফিসে যাওয়া আসার সময়টা তো বেচে যাচ্ছে! win-win situation বজায় রাখুন। কাজ করুন এবং নির্দিষ্ট সময় কাজ শেষে উঠে পড়ুন। বিশ্রাম নিন। টানা কাজ করবেন না। অবসরকে কাজে লাগান।

প্রথম পোষ্ট তো, আবেগে পড়ে অনেক কিছু লিখে ফেলেছি। তবে আপনার যদি এই লিখাটা কাজে লাগে তাহলে জানাবেন। আরেকটু আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ব।

বাসায় থাকুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন, সুস্থ থাকুন!

শেয়ার করুন